রেলওয়ে স্টেশন থেকে কুড়িয়ে পাওয়া মেয়েটাই মা–বাবার ভরসা.

মেয়েটার নাম পরিনা। অর্থাৎ পরি নয়—মানুষ। এ রকম করেও তাঁর নামের অর্থ করা যায়। আসলে তাঁর পালক বাবা তাঁকে পড়ে (কুড়িয়ে) পেয়েছিলেন। এই ‘পড়ে পাওয়া’ শব্দের সঙ্গে মিল রেখে তাঁর ফুফু কাদো বেগম মেয়ের নাম রেখেছিলেন পরিনা। শুধুই ‘পরিনা’; তার আগে–পরে আর কিছুই নেই।

সেই পরিনা পারেন না এমন কোনো কাজ নেই। অনেক সময় ছেলেরা যা পারে না, পরিনা তা করে দেখান। যেমন অনেক ছেলেই বৃদ্ধ বাবা-মাকে দেখাশোনা করেন না। কেউ পাঠিয়ে দেন বৃদ্ধাশ্রমে। এই সমাজে পরিনা তাঁর পালক বাবা-মাকে দেখাশোনার জন্য বিয়েই করেননি। ভেবেছেন, যদি পরের ঘরে গিয়ে বাবা-মাকে দেখাশোনা করার সুযোগ না পান। তিনি ছাড়া তাঁর বাবা মায়ের যে আর কেউ নেই!

পরিনার বয়স এখন ২৯ বছর। ভেবেছেন, যত দিন বাবা-মা বেঁচে থাকবেন, তত দিন তাঁদের পাশে থাকবেন। তারপর টাকাপয়সা হলে একটা বৃদ্ধাশ্রম করবেন। সেখানে অন্য অসহায় বাবা-মায়ের সেবা করে জীবনটা কাটিয়ে দেবেন।

পরিনা যখন শিশু, তখন সান্তাহার রেলওয়ে স্টেশনে কাঁদছিল। তখন তার বয়স ছিল প্রায় ১০ মাস। স্টেশনের কলার ব্যাপারী আব্দুল ওহাব নিঃসন্তান ছিলেন। তিনি শিশুটিকে বুকে জড়িয়ে নিলেন। ‘বাচ্চা কার গো’—বলে হাঁকডাক দিলেন। কেউ কোনো সাড়া দিলেন না। দূরে একজন নারী শুধু দাঁড়িয়ে এই দৃশ্য দেখছিলেন। তাঁর কাছে গিয়ে আব্দুল ওহাব বললেন, ‘বাচ্চাটা কি তোমার?’ মেয়েটি কোনো কথা বললেন না।

আব্দুল ওহাব বলেন, ‘আমার কোনো ছেলেমেয়ে নেই। বাচ্চাটা আমি নিয়ে গেলাম। বাচ্চাটা যদি তোমার হয়, কোনো দিন মন চাইলে আমার বাড়িতে এসে দেখে যেয়ো।’ এই বলে ঠিকানা দিয়ে আসেন। কিন্তু ওই নারী কোনো দিন তাঁর বাড়িতে মেয়েকে দেখতে আসেননি।

পরিনা বড় হয়ে পালক বাবা-মায়ের কাছে এই গল্প শুনেছেন। পরিনার পালক মায়ের নাম সাহিদা বেগম। বাবার বয়স এখন প্রায় ৮৫ বছর। মায়েরও কাছাকাছি। বাড়ি নওগাঁর বদলগাছী উপজেলায়। বাবা সান্তাহার স্টেশনে কলা বিক্রি করতে যেতেন। একটু বড় হলে পরিনাও বাবার সঙ্গে যেত।

পরিনার মনে আছে, কলা বিক্রি করে যে কয় টাকা লাভ হতো, সেই টাকা দিয়ে পরিনা বাজারে যা খেতে চাইত, বাবা তা–ই কিনে দিতেন। তারপর মেয়েকে ডালার ওপর বসিয়ে নিয়ে বাড়ি ফিরতেন। বাবার এই ভালোবাসার কথা পরিনা কিছুতেই ভুলতে পারেন না। বাবা–মায়ের এই ভালোবাসা ছাড়া পরিনার শৈশব জীবন খুবই দুর্বিষহ ছিল। খেলার সাথিদের সঙ্গে খেলতে গেলে তারা বলত, ‘তোর বাপ–মায়ের নাম নাই। তোকে কুড়িয়ে এনেছে।’

এসব কারণে ছোটবেলায় তাঁর খেলার কোনো সাথি ছিল না। সে কারও সঙ্গে মিশতে পারত না। বিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার পরেও সহপাঠীদের কাছ থেকে একই রকম কথা শুনতে শুনতে তাঁর মন সারাক্ষণ খারাপ থাকত। তাই কোনো সহপাঠী কোনো দিন তাঁর বন্ধু হয়নি। বিদ্যালয় তাঁর ভালো লাগত না।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Shopping Cart